পেডিয়াট্রিক সার্জারীর সিনিয়ার হাউসস্টাফ তখন। আউটডোরে একটা টেবিলের তিনদিকে আমরা তিনজন বসতাম—স্যার ডা পি কে সরকার, আরএমও সুমিত্রদা (বিশ্বাস) আর আমি। স্যার রোগী দেখে প্রেসক্রিপশন ডিক্টেট করতেন, আমি লিখে নিতাম। একজন বাচ্চাকে দেখে স্যার যথাযথ মাত্রায় কোট্রাইমোক্সাজোল আর প্যারাসিটামল লিখতে বললেন, লিখলাম। তৃতীয় ওষুধ—একটা টনিক। আমি স্যারের দিকে প্রেসক্রিপশন এগিয়ে দিলাম—স্যার আমি এটা লিখতে পারবো না, আপনি লিখুন। স্যার আমার আপত্তির কারণ বুঝতে পারলেন। সেই রোগীকে টনিক লেখা হল না।
কেবল টনিকই নয়, কাশির সিরাপ, হজমী এনজাইম, অযৌক্তিক ফিক্সড ডোজ কম্বিনেশন (একাধিক ওষুধের নির্দিষ্ট মাত্রায় মিশ্রণ) বা ক্ষতিকর ওষুধ সজ্ঞানে লিখিনি ডাক্তার হওয়ার পরের ৩২ বছরে। কেবল আমি নই, আমার মতো আরও কিছু ডাক্তার আছেন, আমরা যারা এক আন্দোলনের শরিক—ওষুধের যুক্তিসঙ্গত ব্যবহারের আন্দোলন।
আশির দশকের শুরুর কথা। তার প্রায় বছর দশেক আগে, ১৯৭৫-এ ওষুধ শিল্প নিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ করার উদ্দেশ্যে গঠিত এক সংসদীয় কমিটি তার রিপোর্ট পেশ করে, কমিটির প্রধান কংগ্রেসী সাংসদ জয়শুকলাল হাতি-র নামে এই কমিটির পরিচিতি হাতি কমিটি। এই কমিটি ১১৭টা ওষুধের এক তালিকার কথা বলে যেগুলো দিয়ে ভারতের জনসংখ্যার অধিকাংশের অধিকাংশ অসুখের চিকিৎসা করা যায়। এই ওষুধগুলো যাতে যথাযথ পরিমাণে উৎপাদন করা হয় তার ব্যবস্থা নিতে সুপারিশ করা হয়। সুপারিশ করা হয় ব্র্যান্ড নামের বদলে জেনেরিক নাম ব্যবহারের, ওষুধের মূল্যনিয়ন্ত্রণের যাতে জীবনদায়ী এবং অত্যাবশ্যক ওষুধ সহজলভ্য হয়। যাতে দেশের ওষুধ-শিল্প বিকশিত হতে পারে তাই নির্দিষ্ট কিছু ওষুধ দেশী শিল্পের জন্য সংরক্ষিত করার কথা বলা হয়। ওষুধ-শিল্পে বহুজাতিকের প্রভাব কমানোর জন্য বিদেশী পুঁজি তৎক্ষণাৎ কমিয়ে ৪০% করার কথা বলা হয়, পরে আরও কমিয়ে ২৬%। হাতি কমিটি বাস্তবত ওষুধ-শিল্পের জাতীয়করণের পক্ষে ছিল।
১৯৭৮-এ আলমা-আটার সম্মেলনে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ‘২০০০ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে সবার জন্য স্বাস্থ্য’-এর ঘোষণা করে। তারই প্রস্তুতিতে ১৯৭৭-এ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রথম মডেল অত্যাবশ্যক ওষুধের তালিকা (1st Model List of Essential Medicines)।
১৯৮২-তে প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশের এক সামরিক সরকার জাতীয় ওষুধ নীতি প্রনয়নের উদ্যোগ নেয়।
- একাধিক ওষুধের নির্দিষ্ট মাত্রায় মিশ্রণ (Fixed Dose Combination) নিষিদ্ধ করা হয়।
- বিভিন্ন ফর্মুলেশনে কোডিন ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়।
- বাজার থেকে তুলে নেওয়া হয় কাফ মিক্সচার, থ্রোট লজেন্স, গ্রাইপ ওয়াটার, টনিক এবং এনজাইম মিশ্রণ।
- যে সব ওষুধের কাঁচা মাল দেশে পরযাপ্ত পরিমাণে উৎপাদিত হয়, সেগুলো আমদানী করা নিষিদ্ধ করা হয়।
- এন্টাসিড ও ভিটামিন দেশীয় শিল্পে তৈরীর জন্য সংরক্ষিত রাখা হয়, বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানীগুলোকে বলা হয় তারা যেন কেবল উচ্চতর প্রযুক্তির ওষুধ উৎপাদনে জোর দেয়।
- যে সব ওষুধ ইতিমধ্যে বাংলাদেশে উৎপাদিত হচ্ছে সেগুলোর বিদেশী ব্র্যান্ডকে লাইসেন্স দেওয়া বন্ধ করে দেওয়া হয়।
- ১০৯৯ টা ক্ষতিকর বা অপ্রয়োজনীয় ওষুধ সঙ্গে সঙ্গে নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়, ১৪৬টা ওষুধ এক বছর পরে বাজার থেকে তুলে নিতে বলা হয়।
বাংলাদেশ সরকার এই বিষয়ে সুপারিশ দেওয়ার জন্য এক বিশেষজ্ঞ দল গঠন করেছিল। সেই দল সুপারিশ করেঃ—
- দেশের জন্য ১৫০টা ওষুধের এক অত্যাবশ্যক ওষুধের তালিকা তৈরী করা হোক।
- ওষুধের পেটেন্ট দেওয়া হবে না, ওষুধ তৈরীর পদ্ধতির ওপর সীমিত সময়ের পেটেন্ট দেওয়া হোক।
- সরকার ওষুধ, ওষুধের কাঁচামাল, প্যাকেজিং দ্রব্য, ইত্যাদির মূল্যনিয়ন্ত্রণ করুক।
- শক্তিশালী ওষুধ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গড়ে উঠুক।
এই সব ঘটনাগুলোর পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের স্বাস্থ্য আন্দোলনের কর্মীরাও যুক্তিসঙ্গত ওষুধ নীতির স্বপক্ষে আন্দোলন জোরদার করেন। ১৯৮২-তে গড়ে ওঠে অল ইন্ডিয়া ড্রাগ একশন নেটওয়ার্ক (AIDAN), ১৯৮৪-তে পশ্চিমবঙ্গে গড়ে ওঠে ওয়েস্ট বেঙ্গল ড্রাগ একশন ফোরাম (WBDAF)। ডাক্তার হিসেবে গড়ে ওঠার বছরগুলোতে এই আন্দোলন আমাদের প্রভাবিত করেছিল। পরে আমি যে কর্মসূচীতে যোগ দিই, সেই শহীদ হাসপাতাল ছিল সম্ভবত প্রথম প্রতিষ্ঠান যেখানে যুক্তিসঙ্গত চিকিৎসার নীতিগুলোর বড় মাপের প্রয়োগ হয়।
ড্রাগ একশন ফোরামের পুস্তিকা ‘ওষুধের জন্য মানুষ, না মানুষের জন্য ওষুধ’ সাধারণ মানুষের মতো প্রভাবিত করেছিল আমাদেরও। ড্রাগ একশন ফোরামের পত্রিকা ‘ড্রাগ, ডিজিজ, ডক্টর’ যুক্তিসঙ্গত চিকিৎসায় আমাদের পথ দেখিয়েছে বহু বছর। ৯০-এর দশকের মাঝামাঝি সংগঠকদের মতপার্থক্যে এই পত্রিকা দুরবল হয়ে পড়ে, তখন তার ভূমিকা পালন করতে থাকে ফাউন্ডেশন ফর হেলথ একশনের BODHI—বুলেটিন অফ ড্রাগ এন্ড হেলথ ইনফর্মেশন।
১৯৯৫-এ কানোরিয়ার শ্রমিকদের সঙ্গে যে স্বাস্থ্য কর্মসূচীর শুরু, সেই শ্রমিক-কৃষক মৈত্রী স্বাস্থ্য কেন্দ্রেও যুক্তিসঙ্গত চিকিৎসা নিয়ে লাগাতার পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছি আমরা—তার কথা পরে বলবো।
২০০০ সাল থেকে ফাউন্ডেশন ফর হেলথ একশন-এর সঙ্গে আমাদের সংগঠন শ্রমজীবী স্বাস্থ্য উদ্যোগ যৌথভাবে এক বাংলা দ্বিমাসিক বার করা শুরু করে। অসুখ-বিসুখ নামের এই পত্রিকা সাধারণ মানুষের মধ্যে যুক্তিসঙ্গত চিকিৎসার প্রচারের পাশাপাশি গ্রামীণ চিকিৎসকদের যুক্তিসঙ্গত চিকিৎসায় প্রশিক্ষিত করারও হাতিয়ার ছিল। ২০১১-র পর এই পত্রিকায় আমি থাকতে পারিনি। ২০১১-এর সেপ্টেম্বর থেকে আমাদের স্বাস্থ্য ও বিজ্ঞান বিষয়ক পত্রিকা—স্বাস্থ্যের বৃত্তে।