"সবার জন্য স্বাস্থ্য চাইঃ
সরকার সব নাগরিকের স্বাস্থ্যরক্ষার দায়িত্ব নিক"

আমি মেডিকাল কলেজে ১৯৭৮-’৮৩-র ব্যাচ। কলেজে ভর্তি হই যে বছর, সে বছর অর্থাৎ ১৯৭৮-এরই ৬-১২ সেপ্টেম্বর সোভিয়েত ইউনিয়নের কাজাখিস্তানের রাজধানী আলমা আটায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আহ্বানে প্রাথমিক চিকিৎসা বিষয়ক এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে ঘোষণা করা হয়ঃ Health for All by 2000 A.D.—২০০০ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে বিশ্বের সমস্ত দেশের সরকার নিজ নিজ দেশের সমস্ত নাগরিকের স্বাস্থ্যরক্ষার দায়িত্ব নেবে। ভারতও এই ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করেছিল। আমরা ভাবতাম আর বছর ২০, তারপর দেশের মানুষের স্বাস্থ্যরক্ষার চিন্তা থাকবে না আর। আমরা সরকারের বেতনভুক কর্মী হয়ে চিকিৎসার কাজ করব, রোগীর কাছ থেকে হাত পেতে পয়সা নিতে হবে না।

ডা নর্মান বেথুনের জীবনী ‘The Scalpel the Sword’-এ পড়েছিলাম সামাজিক চিকিৎসা ব্যবস্থা বা socialized medicine সম্পর্কে তাঁর বক্তব্যঃ ‘Socialized medicine means that health protection becomes public property, like the post office, the army, the navy, the judiciary and the school; 2nd: supported by public funds; 3rd: with services available to all, not according to income but according to need. Charity must be abolished and justice substituted. Charity bebases the donor and debauches he recipient; 4th: its workers to be paid by the State, with assured salaries and pensions; 5th: with democratic self government by the health workers themselves.’ –পোস্ট অফিস, স্থল সেনা, নৌবাহিনী, বিচার বিভাগ আর স্কুলের মতো স্বাস্থ্যরক্ষা ব্যবস্থাও হবে রাষ্ট্রের সম্পত্তি। দ্বিতীয়ত সরকারী খরচে তা চলবে। তৃতীয়ত সবাই পরিষেবা পাবে তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী, আয় অনুযায়ী নয়। দয়াদাক্ষিণ্য বিলুপ্ত হোক, তার জায়গা নিক ন্যায়বিচার...চতুর্থত এই ব্যবস্থার কর্মীদের বেতন ও পেনশন দেবে সরকার। পঞ্চমত স্বাস্থ্যকর্মীরাই গণতান্ত্রিক স্বায়ত্তশাসনে এই ব্যবস্থা চালাবেন...।

জেনেছি সবার জন্য স্বাস্থ্য বা সর্বজনীন স্বাস্থ্য পরিষেবা বলতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কি বোঝায়ঃ ‘All people and communities receive the quality services they need, and are protected from health threats, without suffering financial hardship.’ সমস্ত মানুষ ও জন সমূদায় ভালো মানের প্রয়োজনীয় পরিষেবা পাবেন, কোনও আর্থিক দুর্ভোগ ছাড়াই তাঁরা স্বাস্থ্যের ঝুঁকি থেকে সুরক্ষা পাবেন।

আমাদের স্বপ্ন স্বপ্নই রয়ে গেল, বরং ১৯৪৭-পরবর্তী শাসকদের কল্যাণকর রাষ্ট্রের ধারণা থেকে সরে এসে ১৯৯১ থেকে রাষ্ট্র বিশ্ব ব্যাংক আর আন্তর্জাতিক মুদ্রা ভান্ডার-এর নির্দেশ মেনে স্বাস্থ্য-শিক্ষার মতো পরিষেবা ক্ষেত্র থেকে হাত গুটিয়ে নিতে থাকল। স্বাস্থ্য হয়ে উঠল দেশী-বিদেশী পুঁজিপতির চারণক্ষেত্র।

আমরা বারবার বলেছি সরকার স্বাস্থ্যরক্ষার দায়িত্ব নিক। কিন্তু সেটা কি সম্ভব? মানুষ মনে করতেন তেমনটা মরীচিকা। আমরাও ভাবতাম সমাজ না বদলালে, বিপ্লব না হলে এমনটা বুঝি সম্ভব নয়। আমাদের হাতে অস্ত্র তুলে দিল এক সরকারী কমিটি, যেমন ওষুধ নীতির আন্দোলনে হাতিয়ার হয়েছিল সংসদীয় হাথি কমিটির রিপোর্ট।

হ্যাঁ, সরকারী কমিটিই বলা যায়, কেন না যোজনা কমিশন ২০১০-এ গঠন করেছিল High Level Expert Group on Universal Health Coverage—সবার জন্য স্বাস্থ্যের লক্ষ্যে সুপারিশ করার জন্য উচ্চস্তরীয় বিশেষজ্ঞ দল, যার নেতৃত্বে ছিলেন পাবলিক হেলথ ফাউন্ডেশন অফ ইন্ডিয়ার ডা কে. শ্রীনাথ রেড্ডি। এই কমিটির কথা প্রথম শুনি বিনায়কদার কাছে, যাবজ্জীবন কারাদন্ডের মামলায় জামিন পেয়ে কলকাতায় এসেছিলেন বক্তৃতা দিতে, আকাশবাণী কলকাতায় এক রেডিও টকও ছিল। সেই টকে উনি হেলথ এন্টাইটেলমেন্ট কার্ডের কথা বলেন।

উচ্চস্তরীয় বিশেষজ্ঞ দল ২০১১-এ তাঁদের রিপোর্ট পেশ করেন। সংক্ষেপে বলা যায়, তাঁদের সুপারিশ ছিল সরকার স্বাস্থ্যখাতে ব্যয় বাড়িয়ে পরিকাঠামোর উন্নয়ন ঘটিয়ে সব নাগরিকের স্বাস্থ্যরক্ষার দায়িত্ব নিক। তাঁরা হিসেব করে দেখিয়ে দেন কিভাবে এমনটা সম্ভব। ২০১২-এ প্রকাশিত যোজনা কমিশনের প্ল্যান ডকুমেন্টে কিন্তু সেই সুপারিশ গ্রহণ না করে বেসরকারী বীমা কোম্পানী আর বেসরকারী হাসপাতালের হাতে নাগরিকের চিকিৎসার মূল ভার তুলে দেওয়ার কথা বলা হয়।

২০১২-এর শেষে কলকাতা ও শ্রীরামপুরে দুটো ঘরোয়া মিটিং-এ বিশেষজ্ঞ দলের সুপারিশ ও প্ল্যান ডকুমেন্ট নিয়ে কিছু আলোচনা হয়। বড়ো এক আলোচনা হয় ২০১৩-র ১৭ই ফেব্রুয়ারী আকাদেমি অফ ফাইন আর্টসের সভাগৃহে। শ্রীনাথ রেড্ডি যে পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশন স্বাস্থ্য মন্ত্রী গুলাম নবি আজাদের কাছে পেশ করেছিলেন, তার বাংলা অনুবাদ পেশ করি আমি। প্ল্যান ডকুমেন্ট নিয়ে আলোচনা করেন অর্থনীতিবিদ শুভেন্দু দাশগুপ্ত। কেবল আধুনিক চিকিৎসার কথা বলব নাকি হোমিওপ্যাথি-আয়ুর্বেদ ইত্যাদির কথাও, সরকার সবার স্বাস্থ্যের দায়িত্ব নিলে ওষুধ কোম্পানীর বিক্রি বাড়বে কিনা এমন সব বিষয় নিয়ে ছোটখাট মত পার্থক্য থাকলেও ঠিক করা হয় দুটি দলিল মানুষের কাছে নিয়ে যাওয়া হবে। গঠিত হয় এক ঢিলেঢালা নেটওয়ার্ক ‘পিপল ফর হেলথ কেয়ার’।

দক্ষিণবঙ্গে প্রচার শুরু হয়। শুরুতে অনেকে অংশগ্রহণ করলেও দ্রুত অনেকের আগ্রহ কমে আসে। আমরা অর্থাৎ শ্রমজীবী স্বাস্থ্য উদ্যোগের সদস্যরা প্রথম তিনটে আলোচনা সভার আয়োজক ছিলাম না, কিন্তু আমরা দলিলদুটোর রাজনৈতিক গুরুত্ব বুঝে ঠিক করি আর কাউকে পাওয়া যাক না যাক মানুষের কাছে কথাগুলো পৌঁছতেই হবে। শান্তিপুর, ফুলেশ্বর, বনগাঁ, কুলপি, সন্দেশখালি, কলকাতা, হালিশহর, নৈহাটি, বেলিয়াতোড়, পাথরপ্রতিমা, চাকদায় প্রচার চালাই আমরা প্রথম বছরটায়। সঙ্গী হিসেবে কোনখানে স্থানীয় বিজ্ঞান ক্লাব বা সাংস্কৃতিক সংগঠন, কোথাও ট্রেড ইউনিয়ন, কোথাও কৃষক সংগঠন, কোথাও ছাত্র-যুব সংগঠন, কোথাও বা নাগরিক অধিকার রক্ষা সংগঠন।

প্রচারের সামগ্রী পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশনঃ সবার জন্য স্বাস্থ্য মরীচিকা নয়, সবার জন্য অত্যাবশ্যক ওষুধ বিনামূল্যে চাই, রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্য বীমা যোজনা—আপনার কি পাওয়ার কথা আপনি কি পাচ্ছেন। প্রথম ও তৃতীয় বিষয়ের ওপর দুটো বুকলেট বার করা হয়, দ্বিতীয় বিষয়ে একটা ফোল্ডার।

বছর শেষে ২০১৪-র মার্চের শুরুতে কলকাতায় এক বড় সভায় মিলিত হলাম যাঁরা পিপল ফর হেলথ কেয়ার তৈরী করেছিলাম তাঁরা এবং যেখানে যেখানে আমরা প্রচার করেছি সেখানকার সংগঠনগুলোর প্রতিনিধিরা। অনেক আলোচনা হল, কিন্তু পিপল ফর হেলথ কেয়ার বাস্তবত বিলুপ্ত হল সেইদিনই যখন আমরা সংগঠকদের কাছে দায়িত্বশীল অংশগ্রহণ চাইলাম, বললাম নেটওয়ার্কটাকে আরেকটু শক্তপোক্ত করা হোক, সভা ডাকার দায়িত্ব নিন কয়েক জন। কিছু বন্ধু বোধহয় ভাবলেন আমরা এক নতুন সংগঠন গড়ে তার নেতৃত্ব বসতে চাইছি।

আমরা প্রয়াস ছাড়িনি। পরের বছরে প্রচার চালিয়েছি বাঁশবেড়িয়া, বহরমপুর, বাঁকুড়ার রাধানগর, ফুলেশ্বর, কলকাতা, কল্যাণী আর ঝাড়গ্রামে। বুকলেট বার করা হয়েছেঃ পশ্চিমবঙ্গের সরকারী স্বাস্থ্যব্যবস্থায় কি কি বিনামূল্যে পাওয়ার কথা।

২০১৫-র ২১শে মার্চ শ্রমিক কৃষক মৈত্রী স্বাস্থ্য কেন্দ্রের কুড়ি বছর পূর্তি হল। পশ্চিমবঙ্গে আমরা যে কাজ শুরু করেছিলাম ১৯৯৫-এ, তার বিশ বছর। ২১শে মার্চ থেকে ৭ই এপ্রিল, বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস—এই পক্ষাধিক কাল প্রচার তীব্র করা হল। পোস্টার, ব্যাজ, লিফলেট ছাপানো হল, ছাপানো হল হিন্দী ও বাংলায় দুটো অপেক্ষাকৃত বড়ো ফোল্ডার। এই ফোল্ডারে কোন কোন দেশে সরকার নাগরিকের স্বাস্থ্যের দায়িত্ব নেয়, অর্থের যোগান কোথা থেকে আসে সেই সব তথ্য দেওয়া হল। এই সময়ে আমরা প্রচার চালিয়েছি চেঙ্গাইল, মেডিকাল কলেজ, সরবেড়িয়া, পাঁচলা, বেলিয়াতোড়, হালিশহর, শান্তিপুর, ফুলেশ্বর কটন লেবার লাইন, দিকনগর, কাঁদী আর কলকাতার শিবনাথ শাস্ত্রী কলেজে।

আর সেই বছরেরই ১৬ই আগস্ট ৩৩টা সংগঠনকে নিয়ে তৈরী হল ‘সারা বাংলা সবার জন্য স্বাস্থ্য প্রচার কমিটি’। ২৮শে সেপ্টেম্বর কমরেড শংকর গুহ নিয়োগীর ২৪তম শহীদ দিবসে কলকাতা প্রেস ক্লাবে এক অনুষ্ঠানে প্রচার আন্দোলন তীব্রতর করার ঘোষণা করা হল।

সবার জন্য স্বাস্থ্যের দাবীতে দৃপ্ত মিছিল পথ চলল মেডিকাল কলেজ থেকে নীলরতন সরকার মেডিকাল কলেজ অবধি। প্রচার সভা বারাসত, উল্টোডাঙ্গা, কলকাতা, উত্তরপাড়া, বেলিয়াতোড় আর নৈহাটিতে।

এতোদিন সবার জন্য স্বাস্থ্যের দাবীতে প্রচার চালিয়েছি দক্ষিণবঙ্গে। এবার পা ফেললাম উত্তরবঙ্গে। ২০১৫-র ১৯-২২শে নভেম্বর ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতির বিজ্ঞান অভিযান, প্রচার সামগ্রী নিয়ে সাথী হলাম আমরা। দার্জিলিং, জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ার আর কুচবিহার—উত্তরবঙ্গের চারটে জেলার মানুষের কাছে পৌঁছনো শুরু করলাম আমরা। দক্ষিণবঙ্গে আরও প্রচার শিয়াখালা, নৈহাটি, উত্তরপাড়া, চুঁচুড়া, মানকড়, শিবনাথ শাস্ত্রী কলেজ, মেডিকাল কলেজ, গলসি, সরবেড়িয়ার আশপাশের গ্রামগুলো, নোনাডাঙ্গা, পান্ডবেশ্বর, শ্রীরামপুর আর বেহালায়।

সবার জন্য স্বাস্থ্য বিষয়ে এক গণ কনভেনশন স্থির করা হল কলকাতায় ইউনিভার্সিটি ইন্সটিটিউট হলে ২০১৬-এর ২৪শে জানুযারী। ছয়টা জাঠা বা প্রচার দল তৈরী করা হল কনভেনশনকে সফল করতে। একটা উত্তরবঙ্গের চারটে জেলায়, অন্য পাঁচটা যথাক্রমে গ্রামীণ হাওড়া ও সংলগ্ন হুগলী, দক্ষিণ ২৪ পরগণা, বাঁকুড়া ও বর্ধমান, হুগলী শিল্পাঞ্চল এবং নদীয়া ও উত্তর ২৪ পরগণায় প্রচার চালাল।

গণকনভেনশনে বক্তা ছিলেন ডা কে শ্রীনাথ রেড্ডি, ডা বিনায়ক সেন, ডা অরুণ সিংহ। ডা রাহুল মুখার্জী বললেন ব্রিটিশ যুক্তরাজ্যের স্বাস্থ্যব্যবস্থা এনএইচএস নিয়ে, সত্য শিবরামন বললেন চিলি ও কিউবাতে সবার জন্য স্বাস্থ্যের ব্যবস্থা নিয়ে। বিজ্ঞান আন্দোলনের কর্মী বঙ্কিম দত্ত ও অলোকেশ মন্ডল বললেন পশ্চিমবঙ্গে সবার জন্য স্বাস্থ্যের প্রচারাভিযানের অভিজ্ঞতা নিয়ে। কনভেনশনে অংশগ্রহণকারীরা আরো বেশী মানুষের কাছে বার্তা পৌঁছনোর শপথ নিলেন। শ্রীনাথ রেড্ডি এই সফল কনভেনশন ও প্রচার অভিযান দেখে মন্তব্য করেন—উচ্চস্তরীয় বিশেষজ্ঞ দলের সুপারিশ নিয়ে মানুষ যে রাস্তায় নামতে পারে তা তাঁরা কল্পনাও করতে পারেন নি।

৭ই এপ্রিল, ২০১৬ বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবসে প্রচার কমিটির ঘটকেরা নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে আবার দাবী তুললাম সরকার নাগরিকের স্বাস্থ্যের দায়িত্ব নিক।

কনভেনশনের পরে প্রচারে একটু ঢিলে পড়েছিল। প্রচারে গুরুত্ব পায় এবার উত্তরবঙ্গ—শিলিগুড়ি, তিনধারিয়া চা বাগান, মার্গারেটস’ হোপ চা বাগান, জলপাইগুড়ি আর ভারতীয় বিজ্ঞান অভিযানে আবার চারটে জেলা পরিক্রমা। দক্ষিণবঙ্গে আলোচনা সভা হয় শান্তিপুর আর কান্দীতে।

কনভেনশনের বক্তাদের বক্তৃতা ভিডিও রেকর্ডিং করে দিয়েছিলেন বন্ধু সংস্থা ‘শেপ’। শ্রীনাথ রেড্ডির ভাষণ, যদিও তা ইংরেজীতে, কোনো কোনো জায়গায় আমরা প্রচারের জন্য ব্যবহার করেছি।

সারা বাংলা সবার জন্য স্বাস্থ্য প্রচার কমিটি গড়ে উঠেছিল মূলত দক্ষিণবঙ্গের সংগঠনগুলোকে নিয়ে। ২০১৭-র ফেব্রুয়ারী ও মার্চে যথাক্রমে জলপাইগুড়ি ও শিলিগুড়িতে দুটো সভার মধ্যে দিয়ে গড়ে উঠল প্রচার কমিটির উত্তরবঙ্গ শাখা।

সরকার নাগরিকের স্বাস্থ্যের দায়িত্ব নিক—এই আওয়াজ তো কেবল পশ্চিমবঙ্গ থেকে উঠলে হবে, আওয়াজ তুলতে হবে ভারতের প্রতিটা কোণ থেকে। তাই প্রচার আন্দোলনে সম্ভাব্য বন্ধুদের নিয়ে ২০১৭-র ৭ই এপ্রিল এক সম্মেলন করার পরিকল্পনা করা হল।

পশ্চিমবঙ্গের সব সদস্য সংগঠন ছাড়াও ছিলেন নয়া দিল্লী, উত্তর প্রদেশ, মহারাষ্ট্র, তামিলনাড়ু এবং ত্রিপুরার প্রতিনিধিরা। এক সাময়িক জাতীয় প্রচার কমিটি রূপ পেল, প্রচারের সুবিধার জন্য দেশকে পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর, দক্ষিণ এবং মধ্য—এই পাঁচটা জোনে ভাগ করা হল। পশ্চিমবঙ্গের প্রচার জোরদার করার জন্য জেলাগুলোকে ভাগ করা হল ছয়টা জোনে। ঠিক করা হল জাতীয় প্রচার কমিটি প্রথম প্রকাশ্য সম্মেলন হবে নয়া দিল্লীর অল ইন্ডিয়া ইন্সটিটিউট অফ মেডিকাল সায়েন্সেস-এ। এক বুলেটিনের পরিকল্পনা করা হল। ২০১৬-র নাগরিক কনভেনশনের বক্তৃতাগুলোর অনুবাদের এক সঙ্কলন এই দিন প্রকাশিত হল, প্রকাশক গুরুচন্ডালী।

২৬শে আগস্ট এআইআইএমএস-এ কনভেনশন হয়েছে, বক্তা ছিলাম ডা মোহন রাও, ডা কে শ্রীনাথ রেড্ডি, আমি, ডা প্রতাপ শরণ, ডা সুজয় বালা...। এআইআইএমএস-এর জুনিয়ার ডাক্তার ও মেডিকাল ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে এক নতুন উদ্দীপনার সঞ্চার করেছে এই সম্মেলন। ১৮-২৫শে সেপ্টেম্বর এআইআইএমএস-এর বার্ষিক অনুষ্ঠান PULSE-এর মূল থিম সবার জন্য স্বাস্থ্য। ১৭শে সেপ্টেম্বর তাঁরা দৌড়েছেন PULSATHON-এ সবার জন্য উন্নত মানের সমতামূলক সরকারী ব্যবস্থার দাবী নিয়ে।

২০১৩-র ফেব্রুয়ারী থেকে সবার জন্য স্বাস্থ্যের দাবীতে প্রচারের যে কটা মাধ্যম আমাদের আয়ত্বে সবগুলোই ব্যবহার করেছি আমরা। লিফলেট, ফোল্ডার, বুকলেট, বই বার করেছি। আয়োজন করেছি ওয়ার্কশপ, সেমিনার, কনভেনশনের। বক্তব্য রেখেছি স্ট্রীট কর্নারিং-এ, জনসভায়। লিখেছি ম্যাগাজিন ও দৈনিক পত্রিকায়। ডকুমেন্টারী বানিয়েছি। ব্যবহার করেছি ইউটিউব, ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপের মতো সামাজিক মাধ্যম। পথ চলেছি জাঠায়, মিছিলে...।

প্রচারের কোন সুযোগ না ছাড়ার চেষ্টা করেছি। রাজ্যস্তরে সরকারী ডাক্তারদের জেনেরিক নামে প্রেসক্রিপশন লেখার নির্দেশ, ন্যায্য মূল্যের ওষুধের দোকান, ন্যায্য মূল্যে পরীক্ষা-নিরীক্ষা, সরকারী হাসপাতালে বিনামূল্যে ওষুধ সরবরাহের ঘোষণা, ওষুধের পুরো কোর্স দেওয়ার ঘোষণা, সরকারী হাসপাতালে বিনামূল্যে চিকিৎসার ঘোষণা, নতুন ক্লিনিকাল এস্টাব্লিশমেন্ট আইন, ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীদের ওপর ক্রমবর্ধমান আক্রমণ—প্রত্যেকটা সময়েই আমরা সবার জন্য স্বাস্থ্য ব্যবস্থার অপরিহার্যতার কথা প্রচারে নিয়ে গেছি। জাতীয় স্তরে উচ্চস্তরীয় বিশেষজ্ঞ দলের রিপোর্ট এবং ২০১২-র যোজনা কমিশনের দলিল ছাড়াও ২০১৩-র ওষুধের মূল্যনিয়ন্ত্রণ আদেশ, মোদী জমানায় স্বাস্থ্যখাতে ব্যয়হ্রাস, ২০১৫-র খসড়া জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি, কিছু ওষুধের মূল্যনিয়ন্ত্রণ তুলে নেওয়া, ২০১৭-র জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি, ২০১৭-র মার্চে মোদী ও এমসি আই-এর জেনেরিক নামে যুক্তিসঙ্গত প্রেসক্রিপশনের নির্দেশ—সব কটা ক্ষেত্রকেই আমরা প্রচারের কাজে লাগিয়েছি।

পৃথিবীতে সর্ব প্রথম নরওয়ের সরকার নাগরিকের স্বাস্থ্যরক্ষার দায়িত্ব নেয় ১৯১২ খ্রীষ্টাব্দে। তারপর সোভিয়েত ইউনিয়ন, যে দেশে শ্রমিকরাজ স্থাপিত হয়েছিল আজ থেকে ঠিক একশ বছর আগে ১৯১৭ সালে। ১৯৩৬-এ সে দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা দেখে এসে ডা নর্মান বেথুন মন্ট্রিলের ডাক্তারদের এক সভায় বলেছিলেনঃ ‘স্বাস্থ্য সুরক্ষার সবচেয়ে ভালো উপায় হল যে আর্থিক ব্যবস্থা কুস্বাস্থ্যের জন্ম দেয় তাকে বদলে ফেলা, সঙ্গে সঙ্গে অজ্ঞানতা, দারিদ্র ও বেকারি লোপ করা। প্রত্যেকে নিজের নিজের চিকিৎসা কিনবেন এই প্রথা কাজ করবে না। এমনটা অন্যায়, অদক্ষ, সম্পদ নষ্ট হয় এতে, এমনটা এ যুগের জন্য নয়।...প্রবল গতিসম্পন্ন বর্তমান শিল্প সমাজে ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য বলে কিছু হয় না, সমস্ত স্বাস্থ্যই সামূহিক স্বাস্থ্য। একজনের অসুস্থতা বা মানিয়ে নিতে না পারা সমাজের অন্য সবাইকে প্রভাবিত করে। সরকারের উচিত জনস্বাস্থ্য সুরক্ষাকে নিজের প্রাথমিক দায়িত্ব এবং নাগরিকদের প্রতি কর্তব্য হিসেবে স্বীকার করা।’

কিন্তু সরকার তো এমনিতে এই দাবী মেনে নেবে না, সরকারকে বাধ্য করার জন্য চাই গণ আন্দোলন। ছত্তিশগড়ের স্বাস্থ্য আন্দোলনের স্লোগান মনে করুনঃ স্বাস্থ্য কে লিয়ে সংঘর্ষ করো। সংগ্রাম করবেন জনগণ, তাঁদের সচেতন করার কাজ আমাদের। চিকিৎসক জীবনের শুরুতে যে মন্ত্রে আমার দীক্ষা—‘স্বাস্থ্য কোনও ভিক্ষা নয়, স্বাস্থ্য আমার অধিকার’, সেই অধিকারের কথা মানুষকে জানিয়ে যাবো জীবনের বাকী সময়টায়—এমনটাই আমার পরিকল্পনা।