১৯৮৩-’৮৪, আমি তখন ইন্টার্ন। ইন্টার্নশিপ চলছে মেডিসিনে। ইউনিটের প্রধান ডা রায় চৌধুরী মেডিসিনের একটা ইউনিটের প্রধান ছাড়াও নিউরোলজির ইউনিট প্রধান। স্যার আমার জ্যেঠুর সহপাঠী ছিলেন মেডিক্যাল কলেজে। অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির ছাত্র সংগঠন বিপিএসএফ-এর মেডিক্যাল কলেজ ইউনিট গড়ে তোলায় অভিনব ছিল তাঁর ভূমিকা। সরকারী চিকিৎসকদের সংগঠনের নেতা, সে সময়কার শাসক ফ্রন্টের বড় শরিকের ঘনিষ্ঠ। শেষ জীবনে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচারয।
সপ্তাহে একদিন মেডিসিন আউটডোর, দু’দিন নিউরোলজি আঊটডোর। সিনিয়র হাউসটাফ কল্লোলদা। সকাল ৯টা থেকে ইন্টার্নরা নিউরোলজিতে বসতাম এপিলেপ্সি ক্লিনিকে, কয়েক শ’ মৃগীরোগী আসতেন ফলোআপে। নতুন করে ফিট হয়েছে কিনা জেনে নিয়ে ফিট না হলে লিখতাম ‘Rpt. all’। অর্থাৎ আগের ওষুধগুলোই আবার দেওয়া হোক। ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করে মৃগীরোগীরা বছরের পর বছর বড়ো ডাক্তারের দেখা না পেয়ে হাসপাতালের কনিষ্ঠতম ডাক্তারদের দেখিয়ে ফিরে যেতেন।
স্যার হাউসস্টাফদের নিয়ে ওয়ার্ডে রাউন্ড দিয়ে আউটডোরে আসতেন ১১টা নাগাদ। তাঁর জন্য অপেক্ষা করত মন্ত্রী-নেতা-অন্য ডাক্তারদের সুপারিশ। সেই সুপারিশের রোগীদের দেখতে দেখতেই স্যারের সময় কেটে যেত। সুপারিশ নেই যাঁদের, তাঁদের ভাগ্যে আর স্যারকে দেখানোর সুযোগ মিলত না। ইন্টার্ন, হাউসস্টাফ, জুনিয়ার কনসাল্টেন্টদের দেখিয়ে তাঁদের ফিরে যেতে হত। সকাল থেকে সাধারণ রোগীরা অপেক্ষা করছেন, সুপারিশওয়ালা রোগীরা পরে এসে স্যারকে আগে দেখিয়ে চলে যাচ্ছেন। খুব খারাপ লাগত এই ব্যাপারস্যাপার, কিন্তু প্রতিবাদ করার অবস্থায় ছিলাম না। ঠিক করেছিলাম নিজে যখন ডাক্তারী করব, সেখানে এরকম হতে দেব না।
১৯৮৭ বা ’৮৮—শহীদ হাসপাতালে কাজ করি। দুবেলা আউটডোর—সকালে ৯-৩০টা থেকে ১২-৩০টা আর বিকালে ৪-৩০টা থেকে ৭-৩০টা অবধি নাম লেখা। যে রোগী যখন নাম লেখালেন, সেই ক্রমে তাঁকে দেখা হয়। বিকালের আউটডোরে ছোট মেয়েকে নিয়ে দেখাতে এসেছেন শংকর গুহ নিয়োগীর স্ত্রী আশা গুহ নিয়োগী—আশু। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর তিনি অধৈরয হয়ে উঠলেন। মেয়ের টিকিট ছিল আমার কাছে, আমাকে বললেন আগে দেখে দিতে, বাড়ী গিয়ে রান্না করতে হবে। আমি বললাম—‘রান্নাতো অন্য মহিলাদেরও বাড়ী গিয়ে করতে হবে, তাঁদের আগে না দেখে আপনার মেয়েকে আগে দেখব কেন?’ আশু অসন্তুষ্ট হলেন। অপেক্ষা করে মেয়েকে দেখিয়ে গেছিলেন না না দেখিয়ে চলে গিয়েছিলেন এত দিন পরে আর মনে নেই। তবে মনে আছে নিয়োগীকে গিয়ে অভিযোগ করেছিলেন আশু। নিয়োগী আশুকে সমর্থন করেননি, বলেছিলেন ‘ডা গুণ ঠিকই করেছেন, আমাদের হাসপাতালে নেতা বা তার পরিবার-পরিজনের জন্য বিশেষ কোন ব্যবস্থা নেই, সবার জন্যই সমান ব্যবস্থা শহীদ হাসপাতালে।’
দল্লী-রাজহরায় বাঙ্গালী ছিলেন অনেকে, ভিলাই স্টীল প্ল্যান্টের স্থায়ী শ্রমিক-কর্মচারী। বিএসপি হাসপাতালে তাঁদের বিনামূল্যে চিকিৎসার সুযোগ, কিন্তু রোগ হলে চিকিৎসা করাতে গিয়ে মানুষ বোধহয় এমন ডাক্তারকেই দেখাতে পছন্দ করে যাঁর সঙ্গে নিজের ভাষায় কথা বলা যায়। আর ছিলেন দন্ডকারণ্য প্রজেক্টের শরণার্থীরা, বস্তারের কাপসী-পাখাঞ্জোর থেকে একশ’ কিলোমিটারেরও বেশী পথ পেরিয়ে তাঁরা আসতেন শহীদ হাসপাতালের বাঙ্গালী ডাক্তারদের দেখাতে। এই দু’ধরনের রোগীরই আকাঙ্ক্ষা থাকত বাঙ্গালী ডাক্তার তাঁদের বিশেষ যত্ন নিয়ে দেখবেন, ক্রমের আগে দেখে দেবেন। কিন্তু সবার জন্যই সমান ব্যবস্থা তো শহীদ হাসপাতালে। এমনকি ইউনিয়নের কোনও বড় নেতা হাসপাতালে ভর্তি হলে তাঁকেও থাকতে হতো জেনেরাল ওয়ার্ডে অন্য রোগীদের সঙ্গে। স্পেশাল ওয়ার্ড বা কেবিন তৈরীই করাইনি আমরা।
১৯৯৫-এ চেঙ্গাইলে কাজ শুরু করলাম—শ্রমিক-কৃষক মৈত্রী স্বাস্থ্য কেন্দ্র—উদ্যোগ নিয়েছিল কানোরিয়া জুট সংগ্রামী শ্রমিক ইউনিয়ন। শুরুর ওষুধ কেনা, সাজসরঞ্জাম কেনার অল্প কিছু পুঁজি জুগিয়েছিলেন কানোরিয়ার শ্রমিকরা। ’৯৫ থেকে ’৯৮ আমার মাসিক ভাতার ৩০০০ টাকা তাঁরা দিতেন জনপ্রতি ১টাকা চাঁদা তুলে। (অবশ্য কারখানা খোলা থাকলেই এই ব্যবস্থা।) মৈত্রী স্বাস্থ্য কেন্দ্রেও একই নিয়ম—যে যেমন নাম লিখিয়েছেন সেই ক্রমে দেখা হয় তাঁদের। তখন আমি একা ডাক্তার, রোগী গড়ে একশ। ফলে অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করতে হত তাঁদের, যাঁরা পরে নাম লিখিয়েছেন। কানোরিয়ার কিছু শ্রমিকের মনে হল—তাঁরা ডাক্তার বসিয়েছেন, তাঁরা ডাক্তারকে বেতন দেন, সুতরাং তাঁদের বিশেষ সুবিধা পাওয়া উচিত। আমি সবার জন্য সমান ব্যবস্থার পক্ষে রইলাম। তর্ক-বিতর্কে আমাকে পরযযুস্ত করতে না পারায় আমাকে ডাকা হল এক বড় সাধারণ সভায়, শ্রমিকদের সাধারণ সভা।
শ্রমিকদের আমি ইতিহাস মনে করালাম যে ইতিহাস তাঁরাই রচনা করেছেন। কানোরিয়া আন্দোলনের শুরু ১৯৯২-এ। অধিকাংশ ক্ষেত্রে আন্দোলনরত শ্রমিকদের মালিকের কাছে মাথা নোয়াতে হয় তখন, যখন তাঁদের পেটে টান পড়ে। কানোরিয়ায় তা হয়নি, কেননা আন্দোলনের নেতৃত্ব পশ্চিমবঙ্গের গণতান্ত্রিক মানুষ এবং উলুবেড়িয়া মহকুমার শ্রমিক-কৃষক-মধ্যবিত্তের সহায়তায় অনেকগুলো যৌথ রান্নাঘর চালিয়েছিলেন মাসের পর মাস, যেখানে আন্দোলনরত শ্রমিক ও তাঁদের পরিবারের দুবেলা দুমুঠো অন্ন জুটত। আন্দোলনে এক আংশিক বিজয়লাভের পর কানোরিয়ার শ্রমিকরা ১৯৯৪-এর ২রা অক্টোবর এক প্রকাশ্য সভায় শপথ নেন এক হাসপাতাল গড়ে তোলার—আন্দোলনে এলাকার মানুষ যে সহায়তা করেছেন তার প্রতিদানে শ্রমিকদের উপহার।
শ্রমিকদের আমি প্রশ্ন করেছিলাম—অন্যের জন্য আপনাদের যা উপহার, সেখানে নিজেদের জন্য বিশেষ সুবিধা কি দাবী করা যায়? তাঁরা বুঝেছিলেন। মৈত্রী স্বাস্থ্য কেন্দ্রে সুপারিশে কোনও কাজ হয় না, ডাক্তারী কারণ ছাড়া কোনও রোগীকে আগে দেখা হয় না, ডাক্তার বা কর্মীর আত্মীয় পরিজন হলেও না।
একজন ডাক্তার অন্য ডাক্তারকে দেখাতে গেলে বিশেষ সুবিধা পাবেন, এমনটাই রীতি। আমি নিজে এক্ষেত্রে অন্য একটা অনুশীলন করি, সাধারণত আমি নিজের ডাক্তার পরিচয় দিই না। দেখতে চাই ডাক্তারের জায়গা ছেড়ে রোগীর বা তাঁর পরিজনের জায়গায় এসে, রোগী বা তাঁর পরিজনকে ঠিক কোন কোন অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়।