"শংকর গুহ নিয়োগীর সঙ্গে কয়েক বছর - শ্বেতা চক্রবর্তী"
image

চারদিকে যখন রইরই করে খারাপ খবর বয়ে চলেছে,তখনই কী এক অসম্ভব দ্রুততায় আমি একটা অন্যরকম বই পড়ে ফেললাম।আমি উপন্যাস,ছোটগল্পই বেশি পড়ি।কবিতা তো আমার নিত্য সহচরী।কিন্তু এ আমি কী পড়লাম?

উপন্যাস নয়,ছোটগল্প নয়,কবিতা নয়,এ এক অন্য ভুবন।আধুনিক ভারতের শ্রমিক আন্দোলনের কথা।দল্লী-রাজহরার বীর লোহাখনির সৈনিকদের ঘোটক জীবনের কাহিনি।বড় বিচিত্র।বড় কঠিন।অথচ বড় অসহায় আর বড্ড নরম।নিপীড়িত,শোষিত ইত্যাদি শব্দ আমি প্রয়োগ করছি না।ছত্তিশগড় মুক্তি মোর্চার এই কাহিনিতে কমরেড নেতা শঙ্কর গুহ নিয়োগীর জীবন আর তাঁর গভীর,বিপুল সংগ্রামের গল্প পড়তে পড়তে আমি কতবার যে দল্লী-রাজহরায় পৌঁছে গেছি,কতবার যে হাত মুষ্টিবদ্ধ করেছি,কতবার যে আত্মত্যাগের ভাবনায় প্রাণিত হয়েছি,তা গণনার নয়।

খনিশ্রমিকের জীবন মানেই আমার কাছে এতদিন ছিল 'লেডি শ্যাটার্লিজ লাভার'।এর বাইরে যাবার কোনো উপাদান আমার জীবনেও ছিল না,স্বপ্নেও ছিল না।সামান্য ঘাম আমার সহ্য হয় না।একটু রোদেই আমি নেতিয়ে পড়ি।সন্ধ্যাবেলার মৃদু হাওয়ায় আমি ছাতিম বা জুঁইগাছের নিচে চুপটি করে দাঁড়িয়ে আকাশ পাতাল ভাবি।অথচ যখন এই শঙ্কর গুহনিয়োগী নামের বটবৃক্ষটিকে পড়লাম,জানতে পারলাম তাঁর মহাজীবনের কথা,আমি সত্যি অর্থেই এই আন্দোলনের প্রধান গীতিকার কবি ফাগুরাম যাদব হয়ে উঠলাম!ক্লাস ফোর পর্যন্ত পড়াশুনো করা ফাগুরামের সঙ্গে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্ত সার্টিফিকেট বিনিময়ের ইচ্ছে জাগে।মেহনতী মানুষের লাল সবুজের,গঙ্গাযমুনার স্রোতে আমি নাও ভাসিয়ে পাড়ি দিই সেই দূরের দেশে।

দুর্গ,রাজনাদগাঁও,রায়পুর,বস্তার,বিলাসপুর,সরসুজার নদী ঝরনার দেশে শাল,সেগুন,তেন্দু,মহুয়া আর বাঁশের বনে আমার হারিয়ে যাবার ইচ্ছে জাগে।তবু,এ বড় বাস্তব ভূমি।মহামায়া আর আড়িডুংরি খনি থেকে গল্প করতে করতে বেরিয়ে আসা ফাগুরাম আমি কোনোদিন হবো না,কিন্তু গুনগুন করে গাইবো তার গান,"শরাবী ভাইয়া রে মত পিবে বটলকে শরাব লা/মত পিবে বটলকে শরাব লা।"

বইটির নাম 'শঙ্কর গুহ নিয়োগীর সঙ্গে কয়েকটা বছর'।লেখক ডাঃ পুণ্যব্রত গুণ।একজন ডাক্তারের লেখা কবিতার বই আমি পড়েছি।উপন্যাস পড়ে বহুবার অভিভূত রয়েছি,ছোটগল্প পড়ে উল্লসিত হয়েছি,কিন্তু এমন জীবন অভিজ্ঞতার গল্প এই প্রথম পড়ে প্রেরণার মতো লাগছে।এ জীবন আমায় টানতো না এতদিন।এই ঘামের জীবনের আমি কেউ ছিলাম না।কিন্তু এই বইটি আমার ভাবের জীবনে জন্মান্তর ঘটিয়ে আমায় অন্য ভুবনের বাসিন্দা করে রেখেছিল ক'দিন।কী উদাসীন অথচ আসক্ত বেদনায় চিকিৎসক-লেখক বর্ণনা করেছেন তাঁর প্রিয় নায়কের মৃত্যুদৃশ্য।নিহত গুহ নিয়োগীর সেই শেষঘুমের বর্ণনা,"দেশি পিস্তলের বুলেটের ছ-টা ছররা পিঠ ফুঁড়ে হৃৎপিণ্ডকে ফুটো করে দিয়েছে,অথচ মুখে কোনো যন্ত্রণার ছাপ নেই,স্বপ্নদ্রষ্টা আমার নেতা যেন ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কোনো স্বপ্ন দেখছেন,মুখে হালকা একটা হাসি!যেন 'নিয়োগীজি' বলে ডাকলেই চোখ খুলে বলবেন,'কেয়া খবর ডাক্তারসাব'!"এমন অশ্রু বেদনার কথা একজন ডাক্তারের কলমে এসে আমাকেও কাঁদিয়েছে।কতবার যে আমি রাতের স্বপ্নে সেই শ্রমিক নেতাকে দেখলাম,কতবার স্বপ্নেই তাঁকে প্রণাম জানালাম!

বইটির বড় গুণ লেখকের আন্তরিক বর্ণনা আর গতি।এত অনুপুঙ্খ ছবি একটার পর একটা চলেছে যে পড়াটি যেন চলচ্চিত্র দেখা।দল্লী রাজহরার জনস্বাস্থ্য আন্দোলন ও শহীদ হাসপাতালের ছোটো খাটো অপারেশন থেকে বড় অপারেশনের বিস্তারিত বর্ণনা আর সেই সঙ্গে সেখানকার মালিকপক্ষের মেশিনিকরণের বিরোধিতা।বিজ্ঞানবিরোধী হলেও শ্রমিকের জীবন ও স্বার্থের সঙ্গে বৃহত্তরভাবে জড়িত এসব ভাবনার সঙ্গে আমিও কখন যে একাত্ম হয়ে গেছিলাম!

এই বিষয়ে আর একটি ভাবনান্দোলন আমায় গভীর ভাবে নাড়া দিয়েছে।শরাব বন্দি আন্দোলন।মদে আসক্ত শ্রমিকদের নেশা মুক্তির আন্দোলন।এই প্রসঙ্গে লেখকের প্রবল সহানুভূতি আমায় চমৎকৃত করেছে।নিজে সুশিক্ষিত হয়ে শ্রমিকের স্বার্থে,শ্রমিকদের ভালোবেসে তাদের জীবনের সঙ্গে একাঙ্গ হয়ে যাবার জন্যে দরদ লাগে,মহৎ প্রাণ লাগে! ডাক্তার গুণের চরিত্রের এই দিকটি আমার শ্রদ্ধা কেড়ে নেবার পক্ষে যথেষ্ট।

আদিবাসী পরিবারের চোলাই তৈরি আর সেই সূত্রে চিখলী গ্রামের আদিবাসী স্বামী-স্ত্রীর পায়ে অ্যাসিড ঢেলে দেওয়ার অত্যাচারের বর্ণনায় আমি শিউরে উঠেছি।কিন্তু লেখকের নৈর্ব্যক্তিক নিরাবেগ অসামান্য।অথচ সহানুভূতির স্বর্গভ্রষ্ট তিনি একবারও হন নি!

বইটি 'বুকমার্ক',সেতু প্রকাশনীর একটি অসাধারণ প্রয়াস।আপনারা পড়ে দেখতে পারেন।শঙ্কর গুহ নিয়োগীর সহযোদ্ধা একজন চিকিৎসকের এটি একটি ঐতিহাসিক দলিল।মানুষ এবং নেতা গুহ নিয়োগীর কথা চোখে একই সঙ্গে আগুন আর জল আনে।লেখকের বর্ণনা অতিরেক-বর্জিত।অথচ খনিগর্ভের সম্পদের মতোন অনায়াস সম্পদবান।আজ বিকেলে বইটি শেষ হবার পর থেকেই মনে হচ্ছে,সেই আমার থিসিস লেখার সময়ের বীর নায়ককে এতদিনে খুঁজে পেয়ে বেশ ক'দিন তাঁর সঙ্গে রইলাম।এখন মধ্যরাতে দূরে কোথায় রাতজাগানিয়া কুকুরের ডাক যেন আমায় আরো গভীর জীবনবোধের দিকে এগিয়ে দিচ্ছে।আমার মতো ক্ষুদ্র মানুষ এই জীবনকে দেখবো দূর থেকে,দেখবো সবিস্ময়ে,শ্রদ্ধায়,কিন্তু কোনোদিন তল পাবো না!মানবনিয়তির পরিহাস আমি চিনি,কিন্তু স্পর্শ করার সম্পদ আমার কোথায়? প্রণাম নিয়োগীজি।প্রণাম,ডাঃ গুণ!