১৯৮৩-র ৩রা জুন ছত্তিশগড়ের লোহা-খনি শহর দল্লী-রাজহরার ঠিকাদারী শ্রমিকরা শহীদ হাসপাতাল শুরু করেন। শহীদ হাসপাতাল থেকে অনুপ্রেরণা পেলেন পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া জেলার বেলুড়ের ইন্দো-জাপান স্টীলের শ্রমিকরা। ১৯৮৩-র ২রা অক্টোবর শুরু করলেন এক জনস্বাস্থ্য কর্মসূচী—শ্রমজীবী স্বাস্থ্য প্রকল্প। ৯০-এর দশকের শুরুতে এই প্রকল্প রূপ পেল বেলুড় শ্রমজীবী হাসপাতালের। ছত্তিশগড়ের শ্রমিক আন্দোলন থেকে অনুপ্রেরণা পাওয়া কানোরিয়া জুট মিলের শ্রমিকরা ১৯৯৪-এর ২রা অক্টোবর শপথ নিলেন এক স্বাস্থ্য কর্মসূচী গড়ে তোলার। ১৯৯৫-এর ২০ মার্চ হাওড়া জেলার উলুবেড়িয়া মহকুমার চেঙ্গাইলে আরম্ভ হল শ্রমিক-কৃষক মৈত্রী স্বাস্থ্য কেন্দ্র। এই স্বাস্থ্য কেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত ডাক্তার ও স্বাস্থ্য কর্মীরা ১৯৯৯-এ গড়ে তুললেন শ্রমজীবী স্বাস্থ্য উদ্যোগ নামের এক সংগঠন। শ্রমজীবী স্বাস্থ্য উদ্যোগের প্রয়াসে ১৯৯৮ থেকে বাঁকুড়ার বেলিয়াতোড়ে চলে মাসিক স্বাস্থ্য শিবির—মদন মুখার্জী স্মৃতি জনস্বাস্থ্য কেন্দ্র, ২০০০ থেকে হাওড়ার বাউড়িয়া শিল্পাঞ্চলে চলে বাউড়িয়া শ্রমিক-কৃষক মৈত্রী স্বাস্থ্য কেন্দ্র, ২০০৭ থেকে হাওড়ার বাইনানে বাইনান শ্রমিক-কৃষক মৈত্রী স্বাস্থ্য কেন্দ্র, ২০০৯ থেকে সুন্দরবনের জেমসপুরে সুন্দরবন সীমান্ত স্বাস্থ্য পরিষেবা। উত্তর ২৪ পরগণার সরবেড়িয়ায় সরবেড়িয়া কৃষি চক্র ১৯৯৯ থেকে মাসে দু’বার করে মেডিকাল ক্যাম্প চালাতেন। ২০০২ থেকে তাঁরা শুরু করেন সুন্দরবন শ্রমজীবী হাসপাতাল।
যে চারটে হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যকেন্দ্রের নাম করলাম, তার সব কটাতেই কোনও না কোনও সময় কাজ করেছি আমি। ১৯৮৩-’৮৪-তে, বেলুড় শ্রমজীবী স্বাস্থ্য প্রকল্পের শুরুর দিনগুলোতে আমি তাতে যুক্ত ছিলাম, তখন আমি জুনিয়ার ডাক্তার। ১৯৮৬-১৯৯৪-এ ছিলাম শহীদ হাসপাতালে। ১৯৯৫ থেকে আমি শ্রমিক-কৃষক মৈত্রী স্বাস্থ্য কেন্দ্রের সংগঠক চিকিৎসক। আর ২০১৪-র জানুয়ারী থেকে আংশিক সময়ের চিকিৎসক হিসেবে যুক্ত হলাম সুন্দরবন শ্রমজীবীতে।
এই চারটে কর্মসূচীরই একটা সাধারণ বৈশিষ্ট্য হল—এরা কম খরচে চিকিৎসা করে। কম খরচ কেন?! বিনা পয়সায় চিকিৎসা করে এমন সংস্থারও তো অভাব নেই। কেন কম খরচে চিকিৎসা—সেবা করা?
এই স্বাস্থ্য কেন্দ্র বা হাসপাতালগুলো যে জনসমুদায়ের কাছে পরিষেবা পৌঁছায় দেশের মোট জনসংখ্যার তুলনায় তা অতিক্ষুদ্র এক ভগ্নাংশ। আর রোগী হিসেবে যে গরীব মানুষেরা এদের কাছে আসেন, অনেক সময়ই দেখা যায়— কম খরচের চিকিৎসা কেনার সামর্থ্যও তাঁদের থাকে না অনেক সময়। তাহলে কি উদ্দেশ্যে এঁদের চিকিৎসা-প্রতিষ্ঠান চালানো?
শহীদ হাসপাতাল-বেলুড় শ্রমজীবী গড়ে উঠেছিল আশির দশকের শুরুতে। সেই সময়টা দেখুন। ১৯৭৮-এ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ডাক দিয়েছে—‘২০০০ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে সবার জন্য স্বাস্থ্য’। ১৯৭৭-এ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রকাশ করেছে অত্যাবশ্যক ওষুধের প্রথম তালিকা। ১৯৮২-তে পড়শি বাংলাদেশ জাতীয় ওষুধ নীতি ঘোষণা করেছে—অপ্রয়োজনীয় ও ক্ষতিকর ওষুধ নিষিদ্ধ। ১৯৮৩-তে অল বেঙ্গল জুনিয়ার ডক্টর ফেডারেশনের পতাকা-তলে বাংলার জুনিয়ার ডাক্তাররা আওয়াজ তুলেছেন—‘স্বাস্থ্য কোনও ভিক্ষা নয়, স্বাস্থ্য আমার অধিকার’। চিকিৎসক-মেডিকাল ছাত্রছাত্রী-বিজ্ঞানকর্মীরা পশিমবঙ্গে ড্রাগ একশন ফোরাম এবং সরব-ভারতীয় স্তরে অল ইন্ডিয়া ড্রাগ একশন নেটওয়ার্ক গড়ে প্রশ্ন তুলছেন—‘ওষুধের জন্য মানুষ না মানুষের জন্য ওষুধ?’
এই দুটো কর্মসূচীর সংগঠক ডাক্তাররা ছিলেন বাংলার গণতান্ত্রিক মেডিকাল ছাত্র আন্দোলন ও জুনিয়ার ডাক্তার আন্দোলন থেকে উঠে আসা। তাঁরা চেয়েছিলেন শ্রমজীবী মানুষের ন্যায্য আন্দোলনের পাশে থেকে স্বাস্থ্যের কাজ করতে। বিশেষত শহীদ হাসপাতালে তাঁরা আরেকটা কাজ করেছিলেন—ওষুধের যুক্তিসঙ্গত ব্যবহার—হাতে করে দেখা ও দেখানো।
১৯৯৫-এ শ্রমিক-কৃষক মৈত্রী স্বাস্থ্য কেন্দ্র যখন কাজ শুরু করে, তার মধ্যে দেশের স্বাস্থ্যক্ষেত্রে এক বড় পরিবর্তন ঘটে গেছে—বিশ্ব ব্যাংক-আন্তর্জাতিক মুদ্রা ভান্ডারের নির্দেশ মেনে সরকার স্বাস্থ্য-শিক্ষার মতো পরিষেবা-ক্ষেত্র থেকে সরে আসতে শুরু করেছে। সরকারী হাসপাতালে পরিষেবার জন্য পয়সা (ইউজার ফি) নেওয়া শুরু হয়েছে, ফ্রি বেড কমছে, বাড়ছে পেয়িং বেড, সরকারী হাসপাতালে প্রাইভেট পাব্লিক পার্টনারশিপ-এর মাধ্যমে স্বাস্থ্য-ব্যবসায়ীদের দরজা খুলে দেওয়া হচ্ছে, কমদামে জমি দিয়ে-করছাড় দিয়ে বেসরকারী বড় হাসপাতাল খুলতে উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে। সরকার চিকিৎসা-পরিষেবা থেকে সরে আসার অজুহাত দেখাচ্ছে—আধুনিক চিকিৎসা ব্যয়বহুল, সরকারের পক্ষে নাগরিকদের চিকিৎসার দায়িত্ব নেওয়া সম্ভব নয়।
সবার জন্য স্বাস্থ্যের স্বপ্ন-দেখা শ্রমিক-কৃষক মৈত্রী স্বাস্থ্য কেন্দ্র-এর কর্মীরা ঠিক করলেন—এমন এক মডেল গড়ে তুলবেন যাতে প্রমাণ করা যায় আধুনিক চিকিৎসা ব্যয়বহুল নয়।
১৯৯৫ থেকে ১৯ বছর কাটতে চলল—এই মডেলটা অনেকাংশে গড়ে তোলা গেছে। যথাযথ ইতিহাস নেওয়া-শারীরিক পরীক্ষার মাধ্যমে রোগ-নির্ণয়>>ল্যাবরেটরী পরীক্ষার যুক্তিসঙ্গত ব্যবহার>>ওষুধের যুক্তিসঙ্গত ব্যবহার-এর মাধ্যমে প্রাথমিক-মধ্যস্তরের-কোনও কোনও ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ স্তরের চিকিৎসা পরিষেবা দিয়ে তাঁরা প্রমাণ করছেন চিকিৎসাবিদ্যাকে বৈজ্ঞানিক ভাবে ব্যবহার করলে কম খরচে আধুনিক চিকিৎসা দেওয়া যায়, আমরা যদি এত কম খরচে করতে পারি সরকার চাইলে আরও কমে করতে পারে।
আমাদের স্বাস্থ্যকেন্দ্র-হাসপাতাল আরও এক অর্থে মডেল। আমরা এক নতুন সমাজের স্বপ্ন দেখি—যে সমাজে শোষণ থাকবে না, সব মানুষ যেখানে সমান।
- যেখানে সবার জন্য পানীয় জল থাকবে,
- সব ক্ষেতে হবে সেচের ব্যবস্থা,
- সবার হাতে কাজ থাকবে,
- কৃষক যেখানে পাবেন আনাজের সঠিক দাম,
- যেখানে সব গ্রামে হাসপাতাল থাকবে,
- সব শিশুর শিক্ষার জন্য যেখানে স্কুল থাকবে,
- যেখানে সবাই জমি আর থাকার ঘর পাবেন,
- যেখানে গরীবী, শোষণ আর পুঁজিবাদ থাকবে না।
এমন সমাজ কবে হবে? যখন শ্রমিক-কৃষকের রাজ হবে।
--শংকর গুহ নিয়োগী
আমাদের চারপাশে আমরা যে চিকিৎসা-প্রতিষ্ঠানগুলোকে দেখি বর্তমান সমাজের শ্রেণী-বিভাজনের প্রতিফলন সেগুলোর পরিচালনায় পড়ে—মালিক-শ্রমিক, ধনী-নির্ধনের বিভাজন—সবার ওপরে সেখানে মালিক বা ম্যানেজার বা সুপার, তারপর ডাক্তার, তারপর নার্স, তারপর করণিক, সবার নীচে তাঁরা যাঁদের পরিচয় ক্লাস ফোর কর্মী বা জেনেরাল ডিউটি এটেন্ডেন্ট।
নতুন সমাজ গঠনের লড়াই লড়তে লড়তে বা সে লড়াই-এর পাশে থাকার সময় আমরা যে প্রতিষ্ঠানগুলো গড়ে তুলি সেগুলো কিন্তু অন্য রকম—সাম্যবাদী নতুন সমাজের ঝলক দেখা যায় সেগুলোতে। শ্রমিক নেতা শংকর গুহ নিয়োগী একে বলতেন—সংঘর্ষ ও নির্মাণের রাজনীতি।
শহীদ হাসপাতালের সমস্ত চিকিৎসক ও কর্মীরা সপ্তাহে একদিন সবাই মিলে সভায় বসে সমস্ত নীতিগত ও কাজের সিদ্ধান্ত নিতেন, কখনও কখনও সে সভায় যোগ দিতেন ছত্তিশগড় মাইন্স শ্রমিক সংঘের প্রতিনিধিরা, সে সভায় সবার মতামতের গুরুত্ব সমান। সে হাসপাতালে প্রধান চিকিৎসক বলে কোন পদ ছিল না।
প্রায় একই রকম ভাবে চলে শ্রমিক-কৃষক মৈত্রী স্বাস্থ্য কেন্দ্র। সেখানেও প্রধান চিকিৎসক বলে কেউ নেই। তবে সবাইকে নিয়ে সেখানে নিয়মিত বসা যায় না—প্রায় ২৫ জন ডাক্তার, সবাই এক দিনে থাকেন না। তাই পরিচালনার সিদ্ধান্ত নিতে আছে পরিচালন সমিতি, চিকিৎসক ও কর্মীদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনায় অবশ্য সবাই-ই থাকেন।
বেলুড় শ্রমজীবী হাসপাতালের সঙ্গে অনেকদিন কাজের যোগ না থাকায় সেখানকার পরিচালন-পদ্ধতি সম্পর্কে বলতে পারব না। সুন্দরবন শ্রমজীবী হাসপাতালের পরিচালনায় আবার চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মী ছাড়া গ্রামের প্রতিনিধিরাও অংশ গ্রহণ করেন।
এছাড়া এক ধরনের অভ্যাস আমরা করি এই প্রতিষ্ঠানগুলোতে—নতুন সমাজে চিকিৎসকদের পারস্পরিক সম্পর্ক কেমন হবে, কেমন হবে চিকিৎসকদের সঙ্গে চিকিৎসাকর্মী-স্বাস্থ্যকর্মীদের সম্পর্ক, চিকিৎসক ও কর্মীরা কিভাবে রোগীদের সঙ্গে আচরণ করবেন, ভুল সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি কি হওয়া উচিত, রোগীর অভিযোগকে কিভাবে নেওয়া উচিত—এমন সব বিষয় নিয়ে।
চিকিৎসা-সংক্রান্ত ভুল সম্পর্কে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি হোক—
- ভুল না করার চেষ্টা করা,
- ভুল হলে স্বীকার করা,
- ভুল থেকে শিক্ষা নেওয়া।
রোগী বা তাঁর পরিবারে অভিযোগগুলোর প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি হোক—
- অভিযোগ যুক্তিসঙ্গত হলে তা থেকে শিক্ষা নেওয়া এবং সংশোধন করা।
- অভিযোগ যদি যুক্তিযুক্ত নাও হয় তার জন্য রোগীকে দোষী না করা,
- সে অভিযোগকে ভবিষ্যৎ-এর ভুলের বিরুদ্ধে সতর্কবাণী হিসেবে গণ্য করা।
বলতে পারেন এই প্রতিষ্ঠানগুলো নতুন মূল্যবোধের ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মী তৈরীর কারখানা। নতুন সমাজের ঝলক দেখিয়ে নতুন নতুন মানুষকে তারা নতুন সমাজ গড়ার লড়াই-এ আকর্ষণ করে।
এসবই হল আমাদের হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যকেন্দ্র চালানোর কারণ।